![নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল [মূল গ্রন্থের প্রচ্ছদ]](https://i0.wp.com/upload.wikimedia.org/wikipedia/en/thumb/1/15/GabrielGarciaMarquez_NoOneWritesToTheColonel.jpg/200px-GabrielGarciaMarquez_NoOneWritesToTheColonel.jpg)
নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল
কিছুদিন আগেই শেষ হলো ঐতিহ্য প্রকাশনীর মাসব্যাপী বাৎসরিক সেল, সেখান থেকেই কিনেছিলাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের “নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল” , যার অনুবাদ করেছেন অশোক দাশগুপ্ত। মার্কেজের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা পড়েছিলাম জি এইচ হাবীবের অনুবাদে। প্রচন্ড বিরক্তিকর সেই অনুবাদ পড়ার পর থেকেই খুব সাবধানী হয়ে গিয়েছিলাম অনুবাদ পড়ার ক্ষেত্রে, বিশেষত মার্কেজের লেখার অনুবাদগুলি। কিন্তু সেই ভয় অনেকটাই দূর করে দিয়েছেন অনুবাদক , চমৎকার ঝরঝরে একটি অনুবাদ উপহার দিয়ে। মূলত তাঁর চমৎকার অনুবাদের কারণেই বইটি অনেকাংশে সুখপাঠ্য হয়েছে ( অবশ্যই সবার আগে প্রধান কৃতিত্ব মূল লেখকের ), এবং আমি বইটি নিয়ে দুটি কথা বলার সাহস যোগাতে পেরেছি।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ – নামটা শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠে দক্ষিন আমেরিকা, বিপ্লব, জাদু বাস্তবতা আর নিঃসঙ্গতা। জাদু-বাস্তবতা বাদে আর বাকি সবকটি উপাদান নিয়েই গড়ে উঠেছে “নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল” উপন্যাসিকা( Novella )টি। এই গল্পের পটভূমি হিসেবে মার্কেজ ব্যবহার করেছেন কলম্বিয়ার “লা ভায়োলেন্সিয়ার” দিনগুলিকে, যখন সেনাশাসন আর নানা ধরণের সেন্সরশিপ আরোপ করা হচ্ছে সমাজের সর্বত্র।

ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অনুবাদের প্রচ্ছদ
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বৃদ্ধ কর্নেল, যিনি মাত্র বিশ বছর বয়েসেই কর্নেল উপাধি পেয়েছিলেন কর্নেল অরলিয়েনো বুয়েন্দিয়ার ০১ সাথে বিপ্লবে অংশ নিয়ে। কাহিনী মূলত এগিয়ে চলে বৃদ্ধ কর্নেল, তাঁর হাঁপানি আক্রান্ত স্ত্রী এবং তাঁদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের নানা অনুষঙ্গকে নিয়ে। কর্নেল প্রায় পনের বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন প্রতিশ্রুত পেনশন পাবার আশায়। প্রতি শুক্রবারই তিনি লঞ্চঘাটে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পেনশনের চিঠির অপেক্ষায়। সদ্যপ্রয়াত ছেলের রেখে যাওয়া মোরগটিকে তিনি সযত্নে লালন করেন মোরগ লড়াই এ অংশ নেওয়ানোর জন্য, নিজে অভুক্ত থাকেন শুধু মাত্র মোরগটিকে এক বেলা খাওয়ানোর জন্য।
এরকম বহুমাত্রিক টানাপোড়েনের সমান্তরালে লেখক নিখুঁত রেখায় একেঁছেন সমাজের চিত্র, আর ব্যক্তি কর্নেলের সার্বক্ষণিক লড়াই, নিজের সাথে নিজের। যিনি প্রতিনিয়ত অনুভব করেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।কর্নেলের দারিদ্র্যটুকু বেশ প্রকটভাবেই ফুটে উঠে প্রথম লাইনে যখন লেখক বলেন,
……… একটি চাকুর সরু মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কফির সর্বশেষ দানাটা পর্যন্ত কেতলির সাথে মেশালেন। কফি টিনের কিছু মরচের গুড়াও হয়তো তাতে মিশে গেল………
কিন্তু দারিদ্র্যের চরমতম কষাঘাতেও কর্নেল তার আভিজাত্যবোধ কিংবা আত্মাভিমানে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগতে দেননি। তাই উপন্যাসিকটা মূলত একজন বৃদ্ধ, নিঃসংগ পরাজিতের সৈনিকের মনঃস্তাত্বিক দ্বন্দ্বের কাহিনী। একদিকে যখন দিনে কীভাবে খাবার জোটাবেন সেই চিন্তা করেছেন, সেই একই লোকই আবার তার পোষা নধর কান্তি মোরগটি বিক্রি করেও, পরবর্তীতে মত পালটে অগ্রিম নেওয়া টাকাটুকু ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সমস্ত উপন্যাসটিই কলম্বিয়ার তৎকালীন সময়ের চিত্রকে ধারণ করে। দুর্নীতিগ্রস্ত সামরিক শাসনাধীন, ধর্ম প্রভাবান্বিত এক সমাজকেই আমরা দেখতে পাই, যখন কর্নেলের ছেলেকে হত্যা করা হয় মোরগ লড়াই এর আসরে কিংবা গির্জার যাজক ঘন্টাধ্বণি বাজিয়ে সিনেমার সেন্সরশিপ ঘোষণা করেন এবং দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন কারা সেই সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। এ উপন্যাসিকাতেই আমরা তৎকালীন কলম্বিয়াতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার এক কুটিল রূপ এর দেখা পাই , যখন কর্নেলের উকিল তাঁকে জানান যে, ফাইল এখন কোন দপ্তরে আটকা পড়ে আছে তা জানা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। এসব অনিয়মের সমান্তরলেই লেখক একেঁছেন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত রূপ। ‘শাবাস’ নামের যে লোক একসময় কর্নেলের গ্রামে এসেছিলো গলায় সাপ জড়িয়ে ঔষধ বিক্রি করতে, নানা রকম কারসাজিতে সেই বনে যায় সমাজের সবচেয়ে বড় মহাজন – লোক ঠকানোতে যিনি সিদ্ধহস্ত। তৎকালীন সমাজের অসঙ্গতি আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের প্রকট রূপের কথা জানতে পারি যখন গল্পের প্রথম ভাগেই লেখক জানান, বহুদিন পর সে গ্রামে একজন লোক সুস্থ-স্বাভাবিক নিয়মে মারা গিয়েছেন।
এত সব অনাচার, অবিচার আর হাহাকারের মধ্যেও টানটান হয়ে থাকে কর্নেলের আত্মাভিমান। এ কথা আমরা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যখন কর্নেলের স্ত্রী বলেন,
………আমরা অনেক দিন চুলায় হাড়ি উঠাই নি। এটা প্রতিবেশিরা যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য কত দিন আমি পাথর কুড়িয়ে হাড়িতে সিদ্ধ করেছি ………
প্রতিনিয়ত কর্নেলের মধ্যে দুটি বিপরীত সত্বা কাজ করেছে, একটি চেয়েছে মোরগটিকে বিক্রি করে নিজেদের উদরপূর্তি করতে, একই সাথে অপরটি চেয়েছে যেই ‘শাবাস’ নামক মহাজনের কাছে বিক্রি করবে, তার দেখা যেন আজকে না পাওয়া যায়। প্রচ্ছন্নভাবে বোঝা যায়, এত দারিদ্র্যের মধ্যেও কর্নেল স্বপ্ন দেখেছেন – স্বপ্ন দেখেছেন তাঁর পেনশনের টাকা ফেরত পাবার কিংবা মোরগ লড়াইয়ে জিতে নিজের দিন বদলের , হয়তোবা নতুন কোন বিপ্লবেরও। এই স্বপ্নের সবকিছুই অনিশ্চিত হয়ে যায়, যখন পোস্টমাস্টারের নিঃস্পৃহ কন্ঠে শোনা যায়ঃ
কর্নেল, নিশ্চিত করে মানুষের জীবনে যা আসে তার নাম মৃত্যু
সেই মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও কর্নেল লড়াই করে চলেন মোরগটাকে বিক্রি না করার জন্য। উপন্যাসিকাটির শেষ তাই অনেক বেশি আকর্ষনীয়, যখন কর্নেল পচাত্তর বছরে দেনা-পাওনার হিসেব মিটিয়ে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান করেন।
এভাবেই লেখক বিস্তৃত ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন নিঃসঙ্গতাকে। দারিদ্র্য আর আত্মাভিমান সবকিছু ছাপিয়ে অন্তরালের নিঃসঙ্গতাই এ গল্পে মুখ্য হয়ে উঠে। গল্পের প্রতিটি ক্ষণ পাঠক, কর্নেলের চরিত্রের সাথে মিশে যান, অনুভব করেন সেই তীক্ষ্ণ জীবন যন্ত্রনা, শতবর্ষের বয়ে চলা নিরন্তর নিঃসঙ্গতাকে। আর এভাবেই নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল হয়ে উঠে একটি সার্থক মার্কেজীয় রচনা।
০১* কর্নেল অরলিয়েনো বুয়েন্দিয়া – মার্কেজ রচিত নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। এই উপন্যাসের জন্য মার্কেজ সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন।