
মূল গল্প
-অ্যালান মার্শাল
প্রায় বছরখানেক পর কোন সার্কাস দল সে’দিন শহরে এলো। বিশাল বড় এই শহরের এক প্রান্তের এক টুকরা সবুজ জমিতে ওরা তাবু টাঙিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসলো। আর এই তাবুতে ঢোকার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলো জীর্ণশীর্ণ, ধূসর রঙের নিরীহ সাদামাটা গাধটা।
এতোদিন পর কোন সার্কাসদল আসায় স্বাভাবিকভাবেই শহরে সবার মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিলো, ফলে তাবুর আশে পাশের রাস্তাগুলিতে ভীড় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিলো। প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে অনেকেই ঘাড় উঁচু করে চেষ্টা করছিলো একটু ভালো করে দেখার জন্য। তবে সম্ভবত সবচেয়ে করুণ অবস্থা হলো একদম ছোট বাচ্চাদের। তাদেরকে হয়তো তাদের বাবা-মা’রা নিয়ে আসলো, কিন্তু এত লোকের ভীড়ে বেচারারা “রঙিন ওয়াগান” কিংবা “হাতি” – কিছুই দেখতে পেল না, শুধু চোখের সামনে কতগুলি পা ছাড়া। কপাল ভালো হলে হয়তো কেউ তাদের একটু উঁচু করে তুলে ধরে আর তখনি তারা চোখের সামনে দেখতে পায় সার্কাসের সব বিস্ময়কর জিনিসগুলিকে, এবং অবশ্যই সবার শুরুতে সেই গাধাটিকে।
সার্কাসদল এরই মধ্যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার মেরে ঘোষণা করলো, তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সার্কাস তাবু যার মধ্যে কিনা প্রায় হাজার চারেক লোক অনায়াসে এঁটে যায়। প্রতিদিনই প্রচুর লোক টিকিট কেটে খেলা দেখার জন্য তাবুতে ঢুকতে থাকে, আর ঢোকার মুখেই সবাই দেখতে পায় খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা সেই গাধাটিকে।
প্রতি শনিবার তিনটে করে শো হবে বলে ঠিক করা হল, ফলে প্রায় হাজার বারো লোক সে’দিন গাধাটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। এই বিশাল সংখ্যক লোকের কমপক্ষে তিন চতুর্থাংশ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাধাটার পিঠে চাপড় দিয়ে যায়। মোটামুটি হাজার নয়েক চাপড় গাধাটাকে খেতে হয়, এক শনিবার দিনই, আর সারা সপ্তাহের হিসাব করা তো সে’খানে এক দুরূহ ব্যাপার।
এই চাপড়েরও নানা রকম আছে- অধিকাংশই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্য চাপড় মারে; আর বাকিগুলো সাধারণত গর্বিত ভঙ্গিতে মারে বাবারা, তাদের সন্তানদের মুগ্ধ করার জন্য। মায়েরা গাধাটার সামনে এসে অপেক্ষা করে আর তাঁদের বাচ্চারা ভীরু চিত্তে গাধার কাঁধের উপর তাদের হাতটা রাখে। অনেক বাবা প্রায়ই তাদের একদম ছোট বাচ্চাগুলিকে গাধাটার পিঠে দাঁড় করিয়ে দেয়- তারা পিঠের উপর দৌড়ায়, মাথায় খামচি দেয় কিংবা কান ধরে টানাটানি করে। অনেকেই আবার দরদ দেখিয়ে গাধার মুখের মধ্যে জোর করে বাদাম গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। অবশ্য এতে বিশেষ লাভ হলো না কারণ মুখের মধ্যে কারো হাতের স্পর্শ পেলেই গাধাটা জোরে জোরে মাথা নাড়তে শুরু করে আর মুখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে।
এ’দিকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর একজন গাধা বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটতে থাকে, সে এসেই বলা শুরু করে, “আহ ! গাধা…” । নিমিষেই জটলার সবাই তার দিকে ঘুরে তাকায়। গাধা বিশেষজ্ঞ তার হাতটা রাখে গাধার গলাতে, উদাস কণ্ঠে বলতে শুরু করে-
“শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা হয়েছে তোর ! এখন আর কোন ভারী কাজ করতে হয় না … এরকমই হয় রে !”
গলার স্বরে কিছুটা নাটকীয় পরিবর্তন এনে জটলার দিকে তাকিয়ে সে আবার বলা শুরু করে,
“আপনারা বোধহয় জানেন, প্রাচ্যের দেশগুলিতে গাধাগুলি নিজের ওজনের চেয়েও বেশি ওজন টেনে থাকে। ভারবাহী পশু যাকে বলে আর কী …”
মুহূর্তের মধ্যেই জটলার সবার মন সহানুভূতিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়, সবাই বিষণ্ণচিত্তে ঘাড় নাড়তে নাড়তে গাধার পিঠ আরো একবার চাপড়ে তাবুর দিকে হাঁটা শুরু করে। অবশ্য মানুষের এই মনযোগে গাধার বিশেষ কিছু যায় আসে না, সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে আগের মতোই। এমনকি কোন কোন সময় কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেও সে’টা কখনো প্রকাশ করে না। ভাবলেশহীন গাধাটা দাঁড়িয়ে ঝিমাতো, এবং একটু লক্ষ্য করলেই হয়তো বোঝা যেত যে, কোনকিছুই আসলে তার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনা।
দেখতে দেখতে সার্কাসের দিনগুলি প্রায় শেষ হয়ে এলো। একদম শেষদিনে নীল রঙের স্যুট পরা এক গাট্টাগোট্টা লোক বেশ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন তাবুর দিকে। হঠাৎ করে গাধাটার দিকে চোখ পড়ায় তিনি থমকে দাঁড়ালেন। একটু পিছিয়ে যেয়ে গাধাটাকে ভালোমত দেখলেন, এরপর ওপাশে যেয়েও গাধাটাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তারপর আবার এগিয়ে এসে গাধটার মাথায় কী যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখা শেষ করে হেঁটে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ কী মনে করে যেন গাধাটার পিঠে বেশ জোরে, রীতিমত একটা বিরাশি সিক্কার চাপড় মেরে গেলেন। বলা বাহুল্য, এ’টা ছিলো দিনের আট হাজার নম্বর চাপড়।
এতক্ষণ গাধাটা আধা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো, আচমকা এই বিশাল হাতের চাপড়ে সে যেন চমকে উঠে বহু প্রতীক্ষিত কোন সংকেত পেয়ে পেল । নিমিষের মধ্যেই ক্ষিপ্রগতিতে ঘাড়টা তুলে কামড়ে ধরলো সেই লোকের হাত। একটানে কোটের নীল রঙের কাপড়টুকু ছিড়ে নিজের মুখের মধ্যে এনে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বুঁজে প্রশান্তচিত্তে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলো গাধাটা।
আতংকিত লোকটা দ্রুত পিছিয়ে এসে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে তখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে ঠিক কী হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে অবিশ্বাসের গলায় সে বলে উঠলো, “ও আমাকে কামড়ে দিয়েছে !!! ” একটু থেমে ঘৃনার সাথে বলে উঠলো, “একটা বদমাইশ জানোয়ার এ’টা !”
এ’দিকে আশেপাশে জটলা করে থাকা মানুষজনও এখনো ঠিক ঘটনায় ধাতস্ত হয়ে উঠতে পারে নি, তাদের চোখ এখনো ছেড়া স্যুটের সেই ভদ্রলোক আর স্যুটের ছেড়া অংশটুকু মুখে নিয়ে চোখ বুঁজে থাকা গাধাটার দিকে। সেই লোকের ঘৃনাভরা গলার স্বর শুনে সবাই এ ব্যাপারে একমত হলো যে, এ’টা আসলেই একটা বদমাইশ জানোয়ার । ভদ্রলোক কিছুই করেননি, শুধু জানোয়ারটার পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়েছেন আর জানোয়ারটা তাতেই কিনা তাঁকে কামড় দিলো ! কী অকৃতজ্ঞ জানোয়ার রে বাবা…
এরপর পুরো পাঁচ মিনিট আর কেউ গাধার পিঠ চাপড়ে দেয় নি। গাধার জন্য সেটুকুই প্রথমবারের মত পাওয়া স্বাধীনতা …
অনুবাদ করার দুঃসাহস মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম বহুদিন ধরেই, তবে অনুবাদযোগ্য গল্প ( কলেবর এবং কাহিনী- দু’দিক দিয়েই) পাওয়াটা বেশ সমস্যা হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত এই শখপূরণে সাহায্য করেছেন প্রিয় সচল সংসারে এক সন্ন্যাসী। তাঁর ঝোলা থেকেই তিনি এই ভিনদেশি গল্পটি বের করে দিয়েছেন। এ’ছাড়া তাঁর মতামত দিয়েও সাহায্য করেছেন আমার প্রথম অনুবাদ প্রচেষ্টাকে আলোর মুখ দেখাতে। তাই কৃতজ্ঞতা রইলো তাঁর প্রতি।