Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

গানের আমি – ৩

আমরা তখন কলেজে পড়ি, আন্ডারগ্রাউন্ড কালচারের স্বর্ণযুগ। যারা ব্যান্ড মিউজিকের এই কালচারের সাথে পরিচিত না, তাদের জন্য জানানো যেতে পারে যে এই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির না! এই আন্ডারগ্রাউন্ড হচ্ছে ব্যান্ডের- অনেকটা ভাবতে পারেন, মূলধারায় ঠিক অতোটা জনপ্রিয় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন ব্যান্ডগুলিই আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড (আরো কিছু ব্যাপার আছে, তবে আপাতত এভাবেই ভাবতে পারেন)। সে সময় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলির মধ্যে আর্টসেলের দোর্দণ্ড প্রতাপ বললেও কম বলা হয়- দুঃখবিলাস আর অপ্সরী, মিক্সড অ্যালবামের এই দুই ট্র্যাক দিয়ে মোটামুটি উঠতি বয়েসি ছেলেদের মুখে মুখে আর্টসেল। এরপরই বের হলো তাঁদের প্রথম অ্যালবাম অন্য সময়- দুর্দান্ত সব গান ! কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি !

ব্যান্ডের উঠতিকালে যা হয়, প্রকাশিত গান তো বটেই, অপ্রকাশিত গান নিয়েও মানুষের আগ্রহের কমতি থাকে না। সে সময়ই (কিংবা তারও বেশ কিছুটা পরে) প্রথম শুনি আর্টসেলের আনরিলিজড ট্র্যাক, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে। সত্যি বলতে কী গানটা আমার তেমন ভালো লাগেনি। অন্যসময়, ভুল জন্ম, রাহুর গ্রাস, দুঃখবিলাস, রূপক – এইসব গানের পাশে কেমন যেন পানশে লাগলো গানটা। তাই কম্পিউটারের কোন এক কোনায় অনেকদিন পড়েছিলো গানটা। এর মাঝে আর্টসেলের ক্রেজ অনেকটা কমে গিয়েছে, অ্যালবাম অনিয়মিত, আর গান শোনার কানও পেকেছে কিছুটা- সব গানই আর আগের মতো ভালো লাগে না। এরই মধ্যে একটা বৃষ্টির দিনে- ঠিক বৃষ্টির দিন না, প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের একদিনের পর রাতের বেলা ঝুম বৃষ্টি নামলো। আমি গান খুঁজতে খুঁজতে ছাড়লাম ” এই বৃষ্টি ভেজা রাতে”।

এক সময়ের মোটামুটি গানটা শুধু মাত্র পরিবেশের গুণেই যেন মাথার মধ্যে একদম ঢুকে গেলো। খুবই হালকা ইন্সট্রুমেন্টাল ব্যবহার করে গাওয়া গানটার কথাও যে খুব আহামরি তা না, তবু লিংকনের “অদ্ভুত” গলায় “এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি নেই বলে, সময় আমার কাটে না” শুনলে মনে হয় সত্যি সত্যি যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মাঝরাতের সেই ঝুম বৃষ্টির শব্দে গানটা শুনে একদম মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অবাক করা ব্যাপার হলো, এখন আর্টসেলের এই গানটাই বোধহয় আমার সবচে বেশি শোনা হয়। মাঝ রাতে যখন বৃষ্টি হয়, মাঝে মধ্যে গানটা শুনি। আজ আমার এই এই গানটা নিয়ে লেখার, কিংবা আদৌ লেখার কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনাই ছিলো না, কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টির শব্দে মনে হলো, এর চে চমৎকার বিষয় আর কী হতে পারে লেখার !

গানের আমি -২

অনেক বছর আগের কথা। ফিতার ক্যাসেট তার যুগ আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলেছে, অনেকের ঘরেই তখন কম্পিউটার কিংবা সিডি প্লেয়ার- মানুষ সিডিতেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে অচিরেই। আমি তখনো ছাত্র, টুকিটাকি শখের খরচ চালাই টিউশনি করে। সেই বছরের অক্টোবর মাস- সামনেই দিদির জন্মদিন। আমি মানুষকে বই কিংবা সিডি/ডিভিডির বাইরে কোন উপহার দিতে পারি না। ঠিক কোন রকমের নীতির জায়গা থেকে না, আসলে এছাড়া আর কী গিফট দেওয়া যেতে পারে সেটা আমার মাথায় আসে না। সে বছর অনেক ভেবে ঠিক করলাম দিদির জন্য ভালো কোন অডিও সিডি কিনবো। বাসার কাছেই ইস্টার্ন প্লাজাতে যেয়ে চোখ আটকে গেলো লতা মঙ্গেশকরের একটা অডিও সিডির কালেকশনে, মোট পাঁচ সিডি। তখনো সিডির দাম এতোটা পড়ে যায়নি, আর ডিস্কের কোয়ালিটিও বেশ ভালো- দোকানদার পাঁচশ টাকার নিচে কিছুতেই নামলো না। মোটামুটি সহায় সম্বল সব দিয়ে, হাতে এক বক্স সিডি, মুখে এক বিরাট হাসি আর ভিতরে অসম্ভব উত্তেজনা নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। উপহার দেখে যে অসম্ভব রকমের খুশি হয়েছিল দিদি, সেটা বলা আসলে বাহুল্যই।

পাঁচটা সিডির সব গান স্বভাবতই সে সময় শোনা হয়নি, সব আবার সমান ভালোও লাগে নি। সে গানগুলির অনেকগুলিই আগে শুনেছিলাম, পরেও বহুবার শুনেছি। বাছাই করা গান হওয়াতে অধিকাংশ গানই বেশ চমৎকার। এই এতো গানের মধ্যেও একটা গান শুনে যেন ভীষণভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম- মেঘা ছায়ে আধি রাত …

গানটার এই প্রথম লাইনটুকু শুনলেই মনে হয় কোন এক রাতের গভীর অন্ধকারে আকাশ আরো কালো হয়ে গিয়েছে মেঘে। শুধুমাত্র এই সামান্য, ছোট বর্ণনাটুকুতে  আমি ভীষণরকমের মুগ্ধ হয়ে যাই। এই লাইনটার জন্যই গানটা আমি বহুবার শুনেছি। এরপরের লাইনগুলিও চমৎকার তবু শুধু এই বর্ণনাটুকুই যেন আমাকে বার বার টেনে নিয়ে আসে এর কাছে। আজও এতো বছর পর যখন গানটা শুনি, যেন প্রথমদিনের সেই উত্তেজনাটুকুই ফিরে আসে। এই লাইনটা শুনলে যেন আগের মতোই মুগ্ধতায় জড়িয়ে যাই।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত রাতের আকাশে যখন ঘন মেঘ জমতে শুরু করে, চারপাশ এক অবিশ্বাস্যরকমের নিরবতায় মুখর হয়ে উঠে- আমি এই গানটা শুনি, আর মনে হয় বেঁচে থাকুন লতা মঙ্গেশকর, বেঁচে থাকুক এই গভীর রাতের মেঘলা আকাশ… !

প্রতিদিন একটি রুমাল

ইচ্ছা করে রোজই কিছু লিখতে। কতো কিছু চিন্তা করি, তবু কিছুই লেখা হয় না।

গত কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম একটা গানের সাথে আমার অনেক স্মৃতি নিয়ে লেখবো। কৈশোরের এক অদ্ভুত প্রেমের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তবু লেখা হয়ে উঠে না। সারাদিন আমার সবটুকু শক্তি ঢেলে দেই চাকরি নামের দাসত্বে। সন্ধ্যারও পরে কোন এক ভীড় বাসে করে যখন শহরের আরেক প্রান্তে এসে পৌছাই, মাথা কাজ করলেও হাত চলতে চায় না। স্বাভাবিক এবং নির্বিকারভাবেই কিছু না লিখে আমি আরো একটা দিন পার করে ফেলি।

তবু আশা রাখি, রোজ লিখবো। “লেখা হচ্ছে না”- এই ধরণের অনুযোগ হলেও লিখবো। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, এই লেখার শেষের দিকে এটাই আবার বুঝতে পারছি না, কেন লিখবো ?

 

ধুর !

 

টাইম ইউ ওল্ড জিপসি…

গতরাতে গানটা দেখছিলাম ইউটিউবে। শুধুমাত্র গায়কীর গুনেই গানটা অসাধারণ ! তবু যখন তাকিয়ে ছিলাম, জয়া ভাদুরীর সেই সময়ের কিছুটা ভীত, কিছুটা আড়ষ্ট, হয়তো কিছুটা অভিমানীও – চেহারা দেখে সত্যি সত্যি বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো। কী অসাধারণ নিষ্পাপ মুখের অভিব্যক্তি।

তবু হঠাৎই মনে পড়লো কিছুদিন আগেই টিভিতে দেখা তাঁর চেহারা। বয়সের ছাপ, জরার চিহ্ন, শিকড়ের মতো সারা মুখে ছড়িয়ে থাকা বলিরেখা।

হায় সময় !

অনুবাদঃ গাধা

মূল গল্প

-অ্যালান মার্শাল


প্রায় বছরখানেক পর কোন সার্কাস দল সে’দিন শহরে এলো। বিশাল বড় এই শহরের এক প্রান্তের এক টুকরা সবুজ জমিতে ওরা তাবু টাঙিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসলো। আর এই তাবুতে ঢোকার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলো জীর্ণশীর্ণ, ধূসর রঙের নিরীহ সাদামাটা গাধটা।

এতোদিন পর কোন সার্কাসদল আসায় স্বাভাবিকভাবেই শহরে সবার মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিলো, ফলে তাবুর আশে পাশের রাস্তাগুলিতে ভীড় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিলো। প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে অনেকেই ঘাড় উঁচু করে চেষ্টা করছিলো একটু ভালো করে দেখার জন্য। তবে সম্ভবত সবচেয়ে করুণ অবস্থা হলো একদম ছোট বাচ্চাদের। তাদেরকে হয়তো তাদের বাবা-মা’রা নিয়ে আসলো, কিন্তু এত লোকের ভীড়ে বেচারারা “রঙিন ওয়াগান” কিংবা “হাতি” – কিছুই দেখতে পেল না, শুধু চোখের সামনে কতগুলি পা ছাড়া। কপাল ভালো হলে হয়তো কেউ তাদের একটু উঁচু করে তুলে ধরে আর তখনি তারা চোখের সামনে দেখতে পায় সার্কাসের সব বিস্ময়কর জিনিসগুলিকে, এবং অবশ্যই সবার শুরুতে সেই গাধাটিকে।

সার্কাসদল এরই মধ্যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার মেরে ঘোষণা করলো, তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সার্কাস তাবু যার মধ্যে কিনা প্রায় হাজার চারেক লোক অনায়াসে এঁটে যায়। প্রতিদিনই প্রচুর লোক টিকিট কেটে খেলা দেখার জন্য তাবুতে ঢুকতে থাকে, আর ঢোকার মুখেই সবাই দেখতে পায় খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা সেই গাধাটিকে।

প্রতি শনিবার তিনটে করে শো হবে বলে ঠিক করা হল, ফলে প্রায় হাজার বারো লোক সে’দিন গাধাটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। এই বিশাল সংখ্যক লোকের কমপক্ষে তিন চতুর্থাংশ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাধাটার পিঠে চাপড় দিয়ে যায়। মোটামুটি হাজার নয়েক চাপড় গাধাটাকে খেতে হয়, এক শনিবার দিনই, আর সারা সপ্তাহের হিসাব করা তো সে’খানে এক দুরূহ ব্যাপার।

এই চাপড়েরও নানা রকম আছে- অধিকাংশই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্য চাপড় মারে; আর বাকিগুলো সাধারণত গর্বিত ভঙ্গিতে মারে বাবারা, তাদের সন্তানদের মুগ্ধ করার জন্য। মায়েরা গাধাটার সামনে এসে অপেক্ষা করে আর তাঁদের বাচ্চারা ভীরু চিত্তে গাধার কাঁধের উপর তাদের হাতটা রাখে। অনেক বাবা প্রায়ই তাদের একদম ছোট বাচ্চাগুলিকে গাধাটার পিঠে দাঁড় করিয়ে দেয়- তারা পিঠের উপর দৌড়ায়, মাথায় খামচি দেয় কিংবা কান ধরে টানাটানি করে। অনেকেই আবার দরদ দেখিয়ে গাধার মুখের মধ্যে জোর করে বাদাম গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। অবশ্য এতে বিশেষ লাভ হলো না কারণ মুখের মধ্যে কারো হাতের স্পর্শ পেলেই গাধাটা জোরে জোরে মাথা নাড়তে শুরু করে আর মুখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে।

এ’দিকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর একজন গাধা বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটতে থাকে, সে এসেই বলা শুরু করে, “আহ ! গাধা…” । নিমিষেই জটলার সবাই তার দিকে ঘুরে তাকায়। গাধা বিশেষজ্ঞ তার হাতটা রাখে গাধার গলাতে, উদাস কণ্ঠে বলতে শুরু করে-

“শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা হয়েছে তোর ! এখন আর কোন ভারী কাজ করতে হয় না … এরকমই হয় রে !”

গলার স্বরে কিছুটা নাটকীয় পরিবর্তন এনে জটলার দিকে তাকিয়ে সে আবার বলা শুরু করে,

“আপনারা বোধহয় জানেন, প্রাচ্যের দেশগুলিতে গাধাগুলি নিজের ওজনের চেয়েও বেশি ওজন টেনে থাকে। ভারবাহী পশু যাকে বলে আর কী …”

মুহূর্তের মধ্যেই জটলার সবার মন সহানুভূতিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়, সবাই বিষণ্ণচিত্তে ঘাড় নাড়তে নাড়তে গাধার পিঠ আরো একবার চাপড়ে তাবুর দিকে হাঁটা শুরু করে। অবশ্য মানুষের এই মনযোগে গাধার বিশেষ কিছু যায় আসে না, সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে আগের মতোই। এমনকি কোন কোন সময় কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেও সে’টা কখনো প্রকাশ করে না। ভাবলেশহীন গাধাটা দাঁড়িয়ে ঝিমাতো, এবং একটু লক্ষ্য করলেই হয়তো বোঝা যেত যে, কোনকিছুই আসলে তার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনা।

দেখতে দেখতে সার্কাসের দিনগুলি প্রায় শেষ হয়ে এলো। একদম শেষদিনে নীল রঙের স্যুট পরা এক গাট্টাগোট্টা লোক বেশ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন তাবুর দিকে। হঠাৎ করে গাধাটার দিকে চোখ পড়ায় তিনি থমকে দাঁড়ালেন। একটু পিছিয়ে যেয়ে গাধাটাকে ভালোমত দেখলেন, এরপর ওপাশে যেয়েও গাধাটাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তারপর আবার এগিয়ে এসে গাধটার মাথায় কী যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখা শেষ করে হেঁটে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ কী মনে করে যেন গাধাটার পিঠে বেশ জোরে, রীতিমত একটা বিরাশি সিক্কার চাপড় মেরে গেলেন। বলা বাহুল্য, এ’টা ছিলো দিনের আট হাজার নম্বর চাপড়।

এতক্ষণ গাধাটা আধা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো, আচমকা এই বিশাল হাতের চাপড়ে সে যেন চমকে উঠে বহু প্রতীক্ষিত কোন সংকেত পেয়ে পেল । নিমিষের মধ্যেই ক্ষিপ্রগতিতে ঘাড়টা তুলে কামড়ে ধরলো সেই লোকের হাত। একটানে কোটের নীল রঙের কাপড়টুকু ছিড়ে নিজের মুখের মধ্যে এনে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বুঁজে প্রশান্তচিত্তে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলো গাধাটা।

আতংকিত লোকটা দ্রুত পিছিয়ে এসে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে তখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে ঠিক কী হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে অবিশ্বাসের গলায় সে বলে উঠলো, “ও আমাকে কামড়ে দিয়েছে !!! ” একটু থেমে ঘৃনার সাথে বলে উঠলো, “একটা বদমাইশ জানোয়ার এ’টা !”

এ’দিকে আশেপাশে জটলা করে থাকা মানুষজনও এখনো ঠিক ঘটনায় ধাতস্ত হয়ে উঠতে পারে নি, তাদের চোখ এখনো ছেড়া স্যুটের সেই ভদ্রলোক আর স্যুটের ছেড়া অংশটুকু মুখে নিয়ে চোখ বুঁজে থাকা গাধাটার দিকে। সেই লোকের ঘৃনাভরা গলার স্বর শুনে সবাই এ ব্যাপারে একমত হলো যে, এ’টা আসলেই একটা বদমাইশ জানোয়ার । ভদ্রলোক কিছুই করেননি, শুধু জানোয়ারটার পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়েছেন আর জানোয়ারটা তাতেই কিনা তাঁকে কামড় দিলো ! কী অকৃতজ্ঞ জানোয়ার রে বাবা…

এরপর পুরো পাঁচ মিনিট আর কেউ গাধার পিঠ চাপড়ে দেয় নি। গাধার জন্য সেটুকুই প্রথমবারের মত পাওয়া স্বাধীনতা …


অনুবাদ করার দুঃসাহস মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম বহুদিন ধরেই, তবে অনুবাদযোগ্য গল্প ( কলেবর এবং কাহিনী- দু’দিক দিয়েই) পাওয়াটা বেশ সমস্যা হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত এই শখপূরণে সাহায্য করেছেন প্রিয় সচল সংসারে এক সন্ন্যাসী। তাঁর ঝোলা থেকেই তিনি এই ভিনদেশি গল্পটি বের করে দিয়েছেন। এ’ছাড়া তাঁর মতামত দিয়েও সাহায্য করেছেন আমার প্রথম অনুবাদ প্রচেষ্টাকে আলোর মুখ দেখাতে। তাই কৃতজ্ঞতা রইলো তাঁর প্রতি।

কাটাকুটি -০৪

আজকাল প্রায় সারাদিনই বাসায় বসে থাকি। পরীক্ষা ঈদের ছুটি আর নির্বাচনের পর কবে হবে তা এখনো অনিশ্চিত। অগ্যতা সারাদিন  গান শোনা, বই পড়া আর আড্ডা মারা। দেখতে দেখতে শীতকালও চলে আসলো। রাতের বেলায় যখন আড্ডা থেকে বাসায় ফিরি, ঠাণ্ডায় শরীরের অনাবৃত অংশে অদ্ভুত একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। এদিকে দিনের বেলাতেও আকাশের মুখ কয়দিন ভার হয়ে আছে। ছাই রঙের আকাশের যেদিকেই তাকাই, শুধুই নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

Winter Blues বলে একটা শব্দ শুধু এতদিন শুনেই এসেছি, কখনো বুঝতে পারি নি, আমি নিজেও শীতকাল আসলে কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। চারিদিকের সবকিছু কেমন যেন চেপে বসতে যায় আমার উপরে।

এখন সময় কাটে পিঙ্ক ফ্লয়েড কিংবা পোয়েটস অভ দ্য ফল শুনে…

হারাই, সবকিছু

খুব ছোটবেলা থেকেই হারাই সবকিছু। ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান বই, কিংবা এক বৃষ্টির দিনে আমার প্রিয় হলুদ ছাতা। হারাতে হারাতেই বড় হয়ে উঠি।

এই বড় বেলাতেও হারাই অনেক কিছু। একদা প্রিয় এক বন্ধুর গলায় দিনরাত শুনতে শুনতে প্রিয় এক বাংলা গান হারিয়ে ফেলি অজ্ঞাতসারে।

হারায় আরো অনেক কিছু। হারায় লালবাগের কেল্লা, হারায় বহুদিন ধরে দেখতে চাওয়া জাপানি এক চলচ্চিত্র, হারায় বহুকাল পড়তে চাওয়া একটা অনূদিত বই। হারায় সময়, হারায় বিশ্বাস। হারায় দর্শন, হারায় ধানমন্ডির রেঁস্তোরা, হারায় বিখ্যাত শর্টফিল্ম কালেকশন, হারায় অনেক লেখার আইডিয়া, হারায় অনেক চিঠি।

অন্যকোন এক সময়ে ধৈর্য্য ধরে বসে থাকি, নিজেকেই হারিয়ে ফেলার জন্য।

##ঢাকা- রাত ২টা বেজে ৫৪ মিনিট।

চৌঠা অক্টোবর।

কাটাকুটি-০৪

আজ বিকালে মিরপুর বাঁধের উপর গিয়েছিলাম। ঈদের দিন চারিদিকে মানুষের বন্যা। এর মধ্যে কপাল জোরে কীভাবে যেন একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম। সাঁতার পারি না চারজনের কেউই তবু নৌকায় সানন্দে উঠে পড়লাম চারজনই। প্রথমে ঠিক হয়েছিলো আধা ঘন্টা ঘুরবো আমরা। সে হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিলো পনেরো মিনিট যাওয়ার পর মাঝিকে নৌকা ঘোরাতে বলা।

আমরা যাচ্ছিলাম; অনেক জল, অনেক কচুরিপানার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু জলের নিঃস্তব্ধতাকে ভাঙ্গেনি কেউ; শুধু জলের মধ্যে বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। পনের মিনিট কেটে গেলো, আমরা নিশ্চুপ। আমাদের সামনেই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির কিছু বিদ্যুতের টাওয়ার, চার পা ছড়ানো। নৌকা ক্রমশ সেগুলির ভিতর দিয়ে যেতে থাকলো। অনেকটা সময় কেটে গেল বহু বছরের জমে থাকা সব চিন্তায়। আকাশে অনেক মেঘ, আসন্ন ঝড়ের প্রস্তুতিতে অস্বাভাবিক মৌন হয়ে আছে চারপাশ।

নৌকা চলে আসলো টাওয়ারের একদম নিচে। মাথা উঁচু করে দেখতে পেলাম একদম চূড়াটাকে। নৌকা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত কোন এক ভূখণ্ডের দিকে। যতই এগুচ্ছি, দ্রিম-দ্রিম ঢাকের শব্দের মিইয়ে যাওয়া স্বর কানে এসে লাগছে। শৈশব মনটা আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো, “কীসের শব্দ ?” আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেল শব্দটা !

বুঝতে পারছি চেতনার স্পষ্ট সীমারেখাগুলি কেউ যেন সযত্নে মুছে দিচ্ছে। লাল আর নীলের মাঝে কালোর সেই স্পষ্ট দাগটা যেন জলের স্রোতে ধুয়ে যাচ্ছে। মগজের মধ্যে সবকিছু মিলে মিশে একাকার। এখন আর মনে হচ্ছে না আমি মিরপুরে বাঁধের উপর, একটু দূরেই আশুলিয়া। স্মৃতির মধ্যে তালগোল পাঁকিয়ে আমি এখন পৌছে গেছি মহেশখালি। দূরের ওই গ্রাম এখন আর বিরুলিয়া না, বরং কুতুবদিয়া কি সোনাদিয়া।

দূরে সরে যাচ্ছে নৌকা, মুছে যাচ্ছে স্মৃতি। ক্রমশ স্মৃতিহীন এক মানুষ হয়ে যাচ্ছি আমি। চমৎকার !

অস্পৃশ্য কাল

মাঝে মাঝে প্রতারক হয়ে উঠে সময়। নিষিদ্ধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আমাদের সবকিছুকে কঠিন করে তোলে। জীবনের তরঙ্গময়তার সুষমত্ব বলে কিছুই কখনো থাকে না। নিস্তরঙ্গ কালের অলস সময়টুকুর পর আমাদের জন্য বাঁচিয়ে রাখে যাবতীয় ঝঞ্ঝাকে। একের পর এক আঘাতে যখন আমরা রক্তাক্ত হই, হাতজোড় করে ভিক্ষা করি নিঃশ্বাস নেবার অবসরটুকু, তখনো সে থামে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, যখন অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণকেই নিয়তি মেনে নেই, তখন যেন একটু অবসর মিলে। একটু বিশ্রামের পরই আবার ঢুকে পরি চিরন্তন লুপের মধ্যে। কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন… কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন…কন্সট্রাকশন, ডেস্ট্রাকশন… এভাবেই এগিয়ে চলি অনিশ্চিত অন্ধকার সরণী ধরে।

যেভাবে আছি এই দেশে

০১

যাচ্ছে। চাই বা না চাই সময় ঠিকই কেটে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের এনট্রপি বাড়ছে, বাড়ছে আমাদের বয়স আর কমছে পৃথিবীতে থাকার জায়গা।

প্রতিবছরই রমজানের সময়টাতে রীতিমত নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় দুপুর কিংবা বিকালে। তবু এবার যেন কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এই ভাগাড়ে আমরা কত বীভৎসভাবে বেঁচে আছি। পেটের দায়ে ছাত্র পড়াতে হয় মোহাম্মদপুরে। রোজকার ভরসা বারো নম্বর বাস ( অধুনা ছত্রিশ )। চেষ্টা করি আড়াইটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। তিনটার ধারে কাছে বেজে গেলেই সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পাই ঢাকা শহর কি বস্তু ! গতকালকের কথাই ধরা যাক।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে যখন কাওরান বাজার সার্ক ফোয়ারার মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়ানো, চারপাশে তখন জনসমুদ্র বললেও কম বলা হবে। দুই-তিনজন পুলিশ সার্জেন্ট আর ট্রাফিক পুলিশ সতর্কভাবে দাঁড়ানো, যাতে কোন বাসই এখানে না থামতে পারে, কোন লোকজন উঠা নামা না করতে পারে। কাজ অবশ্যই প্রশংসনীয় – যত্রতত্র বাস দাঁড়ানো যে যানজটের মূল কারণের একটি তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দাঁড়াবোই বা কোথায় ? বাংলামোটর বাস থামা নিষেধ, কাওরান বাজার বাস থামা নিষেধ। শাহবাগের পর একমাত্র ফার্মগেট। এই বিশাল রাস্তার মাঝে যারা আছেন তাঁরা কী করবেন তা কেউ জানে না।

অবশ্য পুলিশ সার্জেন্ট অতোটা নির্দয় নন। বাস থামতে দেন, তবে কাওরানবাজারের মোড় থেকে অনেকখানি সামনে। বাস থামতে না থামতেই, হাত দিয়ে ইশারা করেন বাস টান দিতে, কখনো বা লাঠি নিয়ে তাড়া করেন। এর ফলাফল কাল হাতেনাতেই দেখলাম। একলোক বাসে উঠতে যাচ্ছেন, এমন  সময় পুলিশ বাস ধাওয়া দেওয়া মাত্র বাস সজোরে টান মারলো। ভদ্রলোক নিশ্চিতভাবেই দুর্দান্ত রকমের পুণ্যবান, নচেৎ উনার হ্যাঁচরপ্যাঁচর করে বাসে উঠার বদলে সরাসরি উপরে পার্সেল হয়ে যাওয়ার কথা।

এর সমাধাম কী হবে তা ভেবে পাই না। ঢাকায় এত লোক, এরকম না করলে পুলিশের পক্ষে জ্যাম সামলানো মুশকিল – আবার আমার মত যারা ব্রাত্য, লোকাল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন তাঁদের নাভিশ্বাস উঠে যায় এরকম দৌড়ের উপর রাখলে। জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা থেকে লাখ পঞ্চাশেক লোক ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।

০২

আজকাল রাস্তাঘাটে কিংবা ব্লগে আলোচনার হট-টপিক আই সি এল আর ক্রিকেটাররা। সবাই ন্যায় অন্যায়, উচিত অনুচিত আর নিমক হালাল আর হারাম নিয়েই ব্যস্ত। সবাই বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েই খালাস। কিন্তু কেউ একটু তলিয়ে ভাবে না। যেই রাজ্জাককে নিয়ে আমরা খুশিতে বাক-বাকুম কারণ সে আই পি এলে খেলে, সেই আমরাই ত্যক্ত বিরক্ত হই কেন এতগুলি খেলোয়াড় বেইমানি করে আই সি এলে গেল। কেউ কি ভেবে দেখেছেন আই পি এল আর আই সি এল এর তফাৎটা কী ? কোন তফাৎ নেই; শুধু আইপিএল ভারতীয় বোর্ডের তাই আইসিসি অনুমোদন দিয়েছে আর আইসিএল এর কপাল মন্দ তাই পায় নি।

অনেকের দেশপ্রেম যেই বর্গের সমানুপাতিক হারে উত্থিত হচ্ছে, ভয় হয়, কোনদিন না এইসব খেলোয়াড়দের মৃত্যুদন্ড দাবি করে বসে। কয়জন মানুষ ট্যাক্স দেয়, কয়জন মানুষ ঘুষ খায় না নিদেন পক্ষে কয়জন মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে না ? শুধু ভাবতে হবে ক্রিকেটারদেরই।

কেউ কি একবার ভেবেছেন ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকদের কি অবস্থা ? এত টাকার স্রোতের ভেতর তাঁরা কতটা ঠিক আছেন? কেন একজন সামরিক ব্যক্তি ক্রীড়া সংস্থা তথা ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আছেন ? কেউ কি আছেন ? কেউ কি একটু বলবেন ?